।। জাহেল যখন আলেম ।।
.
আল্লাহর এই দুনিয়ায় অনেক জাহেল লোক ছিল যারা ক্বুরআনের কিংবা হাদিসের একটি বাণী শুনেই তাওবাহ করেছিল। জীবনকে বদলে দিয়েছিল। তাদের কেউ ছিল চোর, কেউ ছিল ডাকাত, জালিম, অত্যাচারী, গীবতকারী, মদখোর, কেউ ছিল খুবই খারাপ প্রকৃতির লোক। তাদের কেউ কেউ মালিক বিন দিনার (রহ), ফুদ্বাইল বিন ইয়াদ্ব (রহ), আব্দুল্লাহ বিন মুবারাক (রহ) – এর মত বিখ্যাত সব আলেম পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। মাত্র একটি আয়াত, মাত্র একটি হাদীস তাদের জীবনে এমন পরিবর্তন এনে দিয়েছিল যে, তারা শেষকালে ঈমাম হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
.
ঈমাম ক্বুদামাহ আল মাক্বদিসি (রহ) তার ‘কিতাবুন তাওয়াব্বিন’ কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন।
এক মদখোর ব্যক্তি, সর্বদা মদ্যপ অবস্থায় থাকত, মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। তার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ইবন মাসলামাহ আল-ক্বা’নাবি। আব্দুল্লাহ আজেবাজে যুবকদের সাথে মিশত, তাদের সাথে মদের আসরে বসে সময় পার করত। একদিন সে তার বন্ধুদেরকে বাসায় মদ পানের দাওয়াত দেয়। বাড়ির দরজার সামনে বসে তাদের জন্য অপেক্ষায় করতে থাকে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে এক ব্যক্তি গাধার পিঠে বসে যাচ্ছে, তার পিছনে ও আশেপাশে বেশ কিছু লোক তাকে ঘিরে অনুসরণ করছে। লোকটিকে দেখে আব্দুল্লাহর বেশ আগ্রহ জন্মাল।
কে এই লোক যাকে ঘিরে এত লোকের সমাগম?
–
– “এই লোকটি কে?”, আব্দুল্লাহ ভীড়ের মধ্যে কাউকে জিগ্যেস করল।
– “আরে! উনি তো বিখ্যাত ঈমাম।“ (কেউ একজন উত্তর দিল)
– এই ঈমামের নাম কি?
– শু’বাত ইবন হাজ্জাজ”
– “ঠিক আছে বুঝলাম, তার কাজ কী?”
– “সে একজন মুহাদ্দিস”।
– “মুহাদ্দিস কাকে বলে?”, আব্দুল্লাহ আগ্রহের সাথে জিগ্যেস করল।
– “মুহাদ্দিস হলো সে ব্যক্তি যিনি হাদীস বর্ণনা করেন, হাদীস মুখস্থ করেন, হাদীস শিক্ষা দেন, আর নিজে রাসূল (ﷺ) এর সেই সমস্ত হাদিসের উপর আমল করেন।
তার পরিচয় জানার পর আব্দুল্লাহ, ঈমাম শু’বাহ –এর কাছে গিয়ে বলল,
“আপনি যদি মুহাদ্দিসই হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে একটা হাদীস শোনান”।
গায়ে জীর্ণশীর্ণ লাল রঙের পোশাক এবং হাতে মদের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে, ঈমাম শুবাহ বললেন, “তোমাকে হাদীস শোনানোর মত কেউ মনে হচ্ছে না, আমি তোমাকে হাদীস শোনাতে বাধ্য নই”।
আব্দুল্লাহ একটি ছুরি হাতে নিয়ে ঈমাম শুবাহ’র দিকে তাক করে বলল, “আপনি কী আমাকে হাদীস শোনাবেন নাকি আমি ছুরি দিয়ে আপনাকে আঘাত করব?”
ঈমাম শুবাহ পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলেন। তিনি সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি হাদিস বর্ণনা করলেন, “আবূ মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন,
“যদি তুমি লজ্জাই না কর, তবে যা ইচ্ছে তাই কর।“(১)
.
সুবাহানাল্লাহ! এই হাদিসটি আমরা অনেকবার শুনেছি। কিন্তু আমাদের অন্তরে তেমন কোন দাগ কাটেনি। অথচ রাসূল (ﷺ) – এর এই হাদিসটি শুনে আব্দুল্লাহ’র ভিতরটা কেঁপে উঠল। মনে হল এই হাদিসটা যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে।
সে নিজেকে প্রশ্ন করল, নবী (ﷺ) কী এরকমটাই বলেছেন, তোমার লজ্জা না থাকলে যা ইচ্ছা কর? আমার কী লজ্জা আছে, নাকি নেই? তাকে এক অজানা অস্থিরতা ঘিরে ধরল।
হাতে থাকা ছুরিটি মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল, মদের বোতলটিও ভেঙ্গে ফেলল। অতঃপর এক দৌড়ে তার বাড়ির ভিতরে গিয়ে মদের বোতলগুলির ছিপি খুলে একে একে সব মদ মেঝেতে ঢেলে ফেলে দিল। সে তার মাকে বলল, “মাগো! আমার সঙ্গী সাথীরা একটু পরেই আসবে। তারা আসলে কিছু খাবারের আয়োজন করে দিও, খাওয়া শেষে বলে দিও আমি সব মদ ফেলে দিয়েছি, যাতে তারা ফিরে যায়”।
.
এরপর আব্দুল্লাহ কিছুদিন তার ঘরে একাকী অবস্থান করল। আল্লাহ্র দরবারে কেঁদে কেঁদে তার বিগত জীবনের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইল। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিয়ে বলল, “আজ অবধি জীবনে কী করলাম আমি? মদ পান করে শুধু আল্লাহ্র অবাধ্যতাই করে গেছি”। নিজের ভুল স্বীকার করে সে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করল।
.
একদিন সে ঘর থেকে বের হয়ে তার মাকে বলল, “মাগো! আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, আমি ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে যাচ্ছি, আমি ঈমাম শুবাহর মত হতে চাই। সে একজন মুহাদ্দিস হলে আমি কেন মুহাদ্দিস নই? সে যদি মুহাদ্দিস হতে পারে, আমিও মুহাদ্দিস হতে পারব”।
.
প্রিয় পাঠক! খেয়াল করে দেখুন, যে লোকটি কয়েকদিন আগেও নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল আজকে সে একজন মুহাদ্দিস হতে চাচ্ছে। সে শুধুমাত্র তাওবাহ করেই ক্ষান্ত হয়নি, আল্লাহ্র প্রতি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) – এর প্রতি, দ্বীন ইসলামের প্রতি মুহব্বতের কারণে সে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। সে একজন আলিম হতে চাচ্ছে, একজন হাদীস বিশারদ হতে চাচ্ছে। আল্লাহু আকবর!
.
অতঃপর এলাকার আলেম উলামাদের পরামর্শে আব্দুল্লাহ মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। উনারা সেই সময়ের মদিনার মস্ত বড় আলিম ও মুহাদ্দিস ঈমাম মালিক – এর কাছে ইলম অর্জন করার পরামর্শ দিলেন। আব্দুল্লাহ তার এলাকা বাসরা থেকে মদিনায় চলে গেল। জীবনের বাকী সময়টা সে ঈমাম মালিক (রহ.) এর ছাত্র হিসেবে কাটিয়ে দিল এবং এই বিখ্যাত ঈমামের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করার গৌরব অর্জন করল, অবশেষে একজন রাবী হিসেব মর্যাদা লাভ করল।
.
এখানেই শেষ নয় পাঠক! আপনারা জানেন মহাগ্রন্থ আল ক্বুরআনের পর যদি কোন সহিহ গ্রন্থ থেকে থাকে, তা হলো বুখারী ও মুসলিম। আব্দুল্লাহ ছিলেন ঈমাম বুখারী ও ঈমাম মুসলিমেরও উস্তাদ।
সুবহানাল্লাহ! কতোটা রাজস্বিক প্রত্যাবর্তন হয়েছিল তার। শুধুমাত্র একটা হাদীস একজন মদপানকারীকে মুহাদ্দিস বানিয়ে দিয়েছিল, ঈমামদের ঈমাম পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিল।
.
আমরা নিজেরা ক্বুরআন তিলোওয়াত করি, হাদিসের দারসে বসি, কত ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে নির্ঘুম বয়ান শুনি, জুমুআর দিন খুৎবা শুনি, অনলাইন, ফেসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব, টুইটারে কতশত শায়খদের লেকচার চষে বেড়াই – অথচ এগুলি আমাদের মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর সৃষ্টি করে না, আমাদের জীবনটাকে বদলে দেয় না। আমরা যেমন আছি তেমনটাই রয়ে যাই। হিদায়াত আমাদের ভাগ্যে জুটে না। হায়! আফসোস !

দুআ কবুলের গল্পগুলো
৳ 280.00 ৳ 200.00

দুআ কবুলের গল্পগুলো (২য় খণ্ড)
৳ 280.00 ৳ 200.00
তাওবাহর গল্প
৳ 250.00 ৳ 180.00
পৃষ্ঠা : ১৬০
Description
Author
Author
রাজিব হাসান (Rajib Hasan)
Publisher
Publisher
আযান প্রকাশনী - azan prokashoni
Reviews (0)
Be the first to review “তাওবাহর গল্প” Cancel reply
Reviews
There are no reviews yet.